খবরের বিস্তারিত...


হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রঃ) এর জিবনী

ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৮০ হিজরি মোতাবেক ৭০২ খ্রিষ্টাব্দে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হলো নু’মান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। তাঁর বাল্যকালের ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তিনি ইমাম আযম নামেও সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধিশালী নগর কুফায় এসে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৪-১৫ বছর বয়সে একদিন যখন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তৎকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছ? উত্তরে তিনি অতি দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।’ ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আমি যেন তোমার মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। ভালো আলেমের নিকট তোমার লেখাপড়া শেখা উচিত।’ ইমাম শা’বী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উপদেশ ও অনুপ্রেরণায় ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম হাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আতা ইবনে রবিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম জাফর সাদিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞান লাভের জন্য তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা এবং কুফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত আলেমগণের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে হাদিসের অমূল্য রত্ন সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণীগুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু যাহরা)

কারো কারো মতে, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবি জীবিত ছিলেন। ১০২ হিজরিতে তিনি যখন মদিনা গমন করেন তখন মদিনায় দুজন সাহাবি হযরত সোলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের দর্শন লাভ করেন। তবে তাবে-তাবেয়ী হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শিক্ষকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁদের মাত্র একটি মধ্যস্থতা অবলম্বন করতে হতো। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিসসমূহ সম্পূর্ণ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ। ইমাম আবু হানীফা অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন- ১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৩ হিজরী) ২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৭ হিজরী) ৩) সহল ইবনে সাআদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৮ হিজরী) ৪) আবু তোফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১০ হিজরী) ৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৯ হিজরী) ৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৪ হিজরী) ৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৮৫ হিজরী) হাদিস শাস্ত্রের ‘আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান (আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফার দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফার নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।

মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধিক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।

প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি:) চার বছর নয় মাস কাল ইমাম আবু হানীফা মক্কা শরীফে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানীফার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসিয়দের শাসন-ব্যবস্থা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখগণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ করে ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগনের সে আকাঙ্খা নস্যাত করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্থান মোটেও নিরাপদ ছিল না। শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকালে (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কাশরীফেই অবস্থান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেয যাহাবীর বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে যোগ দিতেন, অনুরূপ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।

তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পান্ডিত্য: তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পান্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহশাস্ত্রেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামি আইনগুলোকে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফি মাযহাবের অনুসারী। ফিকাহশাস্ত্রে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম যুফার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম।

যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করতেন। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)

ইবনে হাযম বলেন, আবু হানীফার সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হতো। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানীর বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ) শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী হারামাইন শরীফাইনে অবস্থানকালে কাশফযোগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অবগত করেছেন যে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)

ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল কারাগারে বসেই ১২ লাখ ৯০ হাজারের অধিক মাসআলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।

ইমাম সাহেব যেমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী ও ধী- শক্তি সম্পন্ন ছিলেন তেমনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা তা অনুমান করা সম্ভব হবে: ‘একদিন ইমাম আবু হানীফা কিরাত ও হাদীস বর্ননায় প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় কোন একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মতামত জিজ্ঞেস করা হল। জবাবে তিনি তার মতাতমত জানালেন। হযরত আমাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জিজ্ঞেস করলেন- এ দলীল তুমি কোথায় পেয়েছ? জবাবে ইমাম সাহেব বললেন, আপনিই তো আমাদেরকে এ হাদীস শুনিয়েছেন। এভাবে ইমাম সাহেব তারই বর্নণাকৃত আরও চারটি হাদীস শুনালেন। ইমাম আমাশ বললেন- যথেষ্ট হয়েছে, আর শুনাতে হবে না। আমি তোমাকে একশত দিনে যা শুনিয়েছি তুমি এক ঘন্টায় তা শুনিয়ে দিলে। আমার ধারনাও ছিল না যে তুমি এ হাদীসগুলোর উপর আমাল করে থাক। “সত্যিই তোমরা ফকীহরা হলে ডাক্তারতুল্য, আর আমরা হলাম ঔষধের দোকানদার।“ আর তুমি তো উভয় দিকই হাসীল করেছ (আল জাওয়াহের আল মুদিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৮৪)।

‘ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর শাগরিদদেরকে যারা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হাফিযে হাদীস ফাযল ইবনি মূসা আস সিনানীকে জিজ্ঞাসা করা হল- ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে যারা অপবাদ গেয়ে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি বললেন- আসল ব্যাপার হল ইামাম আবু হানীফা তাদের সামনে এমন তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করেছেন যার সবটা তারা বুঝতে সক্ষম হয়নি। আর তিনি তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তারা ইমাম সাহেবের সাথে হিংসা আরম্ভ করেছেন’। ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ননা করেন-‘হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমার চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন’।

ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের সংগৃহীত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন- ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জনৈক উস্তাদ ইয়াহইয়া ইবনি আদাম তাঁর সহীহ গ্রন্থে বলেন- ‘ইমাম আবু হানীফা নিজ শহরের সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন এবং তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জীবনের হাদীসগুলোর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল (অর্থাৎ বিভিন্নমুখী হাদীসগুলোর মধ্যে সর্বশেষ হাদীস কোনটি ছিল)। যার দ্বারা অন্যান্যগুলো রহিত সাব্যস্ত করা সহজ হয়।

মোটকথা ইমাম আবু হানীফা কুফা শহরের উলামাদের হাসিলকৃত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন। এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি বরং তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা-মাদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল উলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফকীহদের কেন্দ্রস্থল ছিল, কাজেই এক কথায় বলা চলে যে- মক্কা- মাদীনা ছিল ইলমের মারকায। আর তার মত অসাধারণ ধী- শক্তি সম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর যাবত মক্কা- মাদীনার ইলম হাসিল করা নি:সন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়। এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় (উকূদুল জামান, পৃ- ২২০)। প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা- মাদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন বলে বিভিন্ন লেখক মšতব্য করেছেন (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩, খইরতুল হিসান, পৃ- ২৩।) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনি ইউসূফ আস সালেহী ‘উকূদুল জামান গ্রন্থে দীর্ঘ ২৪ পৃষ্ঠায় ইমাম সাহেবের মাশায়েখদের একটা ফিরিস্তি পেশ করেছেন, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩- ৮৭)।

আল্লামা আলী আল কারী, মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ’র বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের উর্দ্ধে হাদীস বর্ননা করেছেন। আর ‘আল আছার’ গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন’ (আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৭৩)। ইয়াহইয়া ইবনি নাসর বলেন- ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানীফার ঘরে প্রবেশ করি যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন- এগুলো সব হাদীসের কিতাব, এর মধ্যে সামান্য কিছুই আমি বর্ননা করেছি যেগুলো ফলপ্রদ’ (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদু জাওয়াহিরিল মুনীফাহ, ১, ৩১)।

ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যদিও অন্যান্য মুহাদ্দীসদের মত হাদীস শিক্ষা দেয়ার জন্য কোন মাজলীস ছিল না, যেমন ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি করেছেন (মুআত্তা মালিক)। কিন্তু তাঁর শাগরিদগণ তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন কিতাব ও মুসনাদ সংকলন করেছেন যার সংখ্যা দশের উর্দ্ধে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হল- ইমাম আবু ইউসুফ রচিত ‘কিতাবুল আসার’, ইমাম মুহাম্মাদ রচিত ‘কিতাবুল আসার আল মারফুআহ’ ও ‘আল আসারুল মারফুআহ ওয়াল মাওকুফাহ’, মুসনাদুল হাসান ইবনি যিয়াদ আল লু-লুঈ, মুসনাদে হাম্মাদ ইবনি আবু হানীফা ইত্যাদি।

ইমাম বোখারীর অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃতু- ২১৫ হিঃ) যাঁর সনদে ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অধিকাংশ ‘সুলাসিয়্যাত হাদীস’ বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফার ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন” (মানাক্বেবে ইমাম আযম রহ. ১/৯৫)

আবার হাফিয মযযী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেন, “তিনি তাঁর কালের সবচেয়ে বড় আলিম ছিলেন” (তাহ্যীবুত তাহযীব-এর টিকা- ১০ম খন্ড, ৪৫২পৃ.)

ইমাম আবু দাউদ বলেন, নিঃসন্দেহে আবু হানীফা ছিলেন একজন শেষ্ঠ ইমাম। (তাহজীব ১/৪৪৫) জরহ ও তাদিলের (সনদ পর্যালোচনা শাস্ত্র) অন্যতম ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন (মৃত্যু- ২৩৩হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি”- (তাহবীবুত্তাহজীব ৫/৬৩০) আলী ইবনে মাদানী (মৃত্যু- ২৩৪ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা হাদীস শাস্ত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন দোষক্রুটি ছিল না। (জামঈ বয়ানিল ইল্ম ২/১০৮৩)

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিয ইয়াহ্ইয়া বিন হারুন (মৃত্যু- ২০৬ হিঃ) বলেন,“আবু হানীফা ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সত্যবাদী” (আহবারে আবু হানীফা ৩৬) আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-“ইমাম আবু হানীফার মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো”। ( তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১, পৃ: ৪৫০)

একবার হযরত ইয়াহয়া ইবনে মুঈনকে প্রশ্ন করা হলো- হাদীসশাস্ত্রে আবু হানীফা কি আস্থাভাজন ব্যক্তি? সম্ভবতঃ প্রচ্ছন্ন সংশয় আঁচ করতে পেরে দৃপ্তকন্ঠে তিনি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! (মানাকিবুল ইমামমুল আ’যামি লিলমাওয়াফিক- খন্ড:১, পৃষ্ঠা ১৯২)

ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ফিকাহশাস্ত্রের সকল মানুষ আবু হানিফার পরিবারভুক্ত।(আছারুল ফিকহিল ইসলামী, পৃ: ২২৩)

হাফেয যাহাবী তার কিতাবে ইমাম আবু হানিফাকে হাফেযে হাদীসের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। (তাযকিরাতুল হুফফায, পৃ: ১৬০)

বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কোন ব্যক্তি অনুসরনীয় হওয়ার দিক থেকে ইমাম আযম আবু হানিফার চেয়ে অধিক যোগ্য নয়। কেননা আবু হানিফা ইমাম, খোদাভীরু, মুত্তাকী, আলেম ছিলেন। তীক্ষ্ম মেধা ও বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে ইলমকে এমনভাবে বিশ্লেষন করেছেন যে ইতিপূর্বে কেউ তা করতে পারে নি।(খাইরাতুল হিসান, লেখক: ইবনে হাজার হায়ছামী শাফেয়ী)

তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার নামাযের ওযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এতে এটাই বোঝা যায় যে, তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদত, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। কতিপয় কর্মচারীর দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্য তিনি কর্মচারীদের সব সময় সতর্ক করতেন। একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, ‘ক্রেতার নিকট যখন এগুলো বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলো দেখিয়ে দেবে এবং এর মূল্য কম রাখবে।’ কিন্তু পরবর্তী কর্মচারীগণ ভুলক্রমে ক্রেতাকে কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেয়ে খুব ব্যথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেন এবং বিক্রীত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।

খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাঁকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয় । কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যূ হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মনসূর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন ইন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরিতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুত গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্তরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তাঁর জানাযায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী বিজরান কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

Comments

comments